এডিস বা স্ত্রী এনোফিলিক্স মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়। এডিস মশার কামড়ের ফলে, মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হোন। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিয়ে সেই মশা অন্য ব্যক্তিকে কামড় দিলে তাকেও ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রমন করে থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাস বহণ করা মশা এবং ব্যক্তি উভয়ই ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়াতে সমান দায়ী। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে বাঁচতে করণীয় নির্দেশনাবলী পালন করতে। ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ সর্ম্পকে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, একটি এডিস মশা তিন দিনে একবার ডিম দেয়। গবেষণা বলছে, একটি স্ত্রী মশা তার জীবনকালে দুইশত থেকে তিনশত ডিম দিয়ে থাকে। এডিস মশার ডিম অনেকদিন পর্যন্ত নিষিক্ত না হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ ডিম ফুটে লার্ভ হতে বা মশার জন্ম হওয়ার জন্য যে পরিবেশ সেটি না পেলেও প্রায় এক বছর পর্যন্ত নিষিক্ত অবস্থায় অবস্থান করে। তারপর যখন প্রয়োজনীয় জল পায় তখনই এডিস মশার ডিম থেকে বাচ্চা হয়। বুঝতেই পারছেন সহজেই নিধনযোগ্য নয় এডিস মশা।
ডেঙ্গু সংক্রমণের আপডেট:
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদন ডেঙ্গু আপডেট দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে আপডেট প্রদান করে তা কিন্তু সারা বাংলাদেশের সব হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয়না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আপডেটে থাকে ২০টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল এর তথ্য। এছাড়াও থাকে ৫৭টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য আপডেট। অনেক মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা নিতে হাসপাতাল যাচ্ছেনা। সুতরাং তাদের জ্বরের আপডেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য আপডেট থেকে পাওয়া যাবেনা এটাই স্বাভাকি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া তথ্য আপডেট থেকে জানা যায়। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের প্রথম ৮দিনে ডেঙ্গু ভর্তি হয়েছেন ২০,৩৯৩ জন। আর এই সময়ে অর্থাৎ আগস্ট মাসের প্রথম ৮দিনে মারা গেছেন ৮৯ জন। এছাড়াও গত ২৪ ঘন্টায় হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা ২,৭৪২ জন। আর এই সময়ে মারা গেছেন ১৩ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী সেপ্টম্বর মাসে ডেঙ্গু আরো বাড়বে। সেপ্টম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। তাই এখন সময় ডেঙ্গু সংক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে বাঁচতে করণীয় বেশির মানুষ জানে কিন্তু মানেনা। তাদেরকে অবশ্যই ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে বাঁচতে করণীয় সর্স্পকে সচেতন করে তুলতে হবে।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ আছে:
সাধারণত একজন ব্যক্তি যখন এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হোন তখন ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন,
- ডেঙ্গু জ্বর হলে প্রচন্ড মাথা হয়।
- জ্বর হলে সাধারণত তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
- ডেঙ্গু জ্বর হলে কারো কারো ক্ষেত্রে জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পার থেকে লেগেই থাকে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে গা ঘামে জ্বর চলে যায়। কিছু সময় পরে আবার জ্বর আসে।
- ডেঙ্গু জ্বর হলে প্রধান যেলক্ষণ প্রকাশ পায় তাহলো শরীর প্রচন্ড ব্যথা করে।
- জ্বরের আরেকটি লক্ষণ হলো মাথা ব্যথা সাথে চোখ ব্যথা করবে।
- শরীরে লালচে দাগ হবে।
- কারো কারো শরীরে র্যাশ উঠতে পারে।
- ক্ষুদামান্দা হতে পারে।
- ডেঙ্গু জ্বরে হলে কারো কারো বমি বমি ভাব হতে পারে।
এছাড়াও ডেঙ্গু জ্বর যখন তীব্র আকারধারণ করে, তখন আরো কিছু ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়,যেমন,
তীব্র পেটব্যথা, রক্তবমি, পেট ফুলে যাওয়া, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, ত্বকের নিচে রক্ত জমা, শ্বাস কার্য কঠিন ও দ্রুত হওয়া।
ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে বাঁচতে করণীয়:
ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধ করতে হলে কিছু করণীয় আছে যা আমাদের সবারই মেনে চলা উচিত। আসুন দেখে নেওয়া যাক কি কি পরামর্শ আছে।
১. ঢাকা দক্ষিণের মেয়র জনাব আতিকুল ইসলাম ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি শ্লোগান প্রচার করছেন। তাহলো তিন দিনে একদিন, জমা পানি ফেলে দিন।
২. বাড়ির কোথাও বৃষ্টির পানিসহ কোনো পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবেনা।
৩. বাড়ির আঙিনা পরিস্কার করতে হবে।
৪. ঝোপঝাড় পরিস্কার করতে হবে।
৫.ঝোপ-ঝাপেও পানি জমতে দেওয়া যাবেনা। কারণ জমা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে।
৬. দিনে যখন ঘুমাবেন তখন অবশ্যই মশারী টাঙিয়ে ঘুমাবেন।
৭. এডিস মশা দিনের আলোয় বেশি কামড়ায়।
৮. ঘরের সকল জানালায় নেট ব্যবহার করুন। যেন মশা ঢুকতে না পারে।
৯. মশা মারার ব্যাট ব্যবহার করুন।
১০. মশা নিরোধক স্প্রে ব্যবহার করুন।
১১. ছেলে-মেয়েদের ফুলহাতা শার্ট-প্যান্ট, পায়ে জুতা-মুজা পড়ে স্কুলে যেতে হবে।
১২. বাসায় সবসময় আলো-বাতাস ঢুকতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
১৩.বারান্দায় ফুলের টব নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে।
১৪. ফুলের টবে জমে পানি প্রতিদিন ফেলে দিন।
১৫. বাসাবাড়ির ছাদকে অবহেলায় ফেলা রাখা যাবেনা।
১৬. ছাদের কোথায় কোনো ময়লা জমে আছে কিনা তা নিশ্চত করুন।
১৭. ছাদে কোথায় কোনো ময়লা থাকলে পানি জমতে পারে। তাতে এডিস মশার বংশবিস্তারে সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। তাই ছাদের কোথায় ময়লা জমতে দিবেননা।
১৮. সপ্তাহে একদিন মশা নিরোধক স্প্রে ব্যবহার করুন।
১৯. বাসার ছাদে, বারান্দায়, আঙ্গিনায় যেন স্বচ্ছ পানি জমতে পারে এমন জিনিস যেমন, ফুলের টব, ডাবের খোলা, গাড়ির টায়ার ইত্যাদি পড়ে না থাকে। কারণ এসবের মধ্যে জমা থাকা পানিতে মশা বংশবিস্তার করতে পারে।
২০. বাসায় কোন অব্যবহৃত পানির পাত্র থাকলে সেটি পরিস্কার করুন। পরিস্কার করে পাত্রের মুখ উলটিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে দিন।
আরো পড়ুন: ফেসবুক পেজের নাম
ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আরো কিছু করণীয় আছে যা অবহেলা করা উচিৎ হবে না:
২১. বাসায় একাধিক হাইকোমড টয়লেট বা লো কোমড টয়লেট থাকতে পারে। যদি থাকে তাহলে যেগুলো অব্যবহৃত থাকে, অথবা কিছুদিনের জন্যে বাসার বাইরে ঘুরতে যাবেন, বা গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে যাবেন। তাহলে যাওয়ার সময় অবশ্যই টয়লেটের প্যানের মধ্যে হারপিক বা ব্লিচং পাউডার দিয়ে মুখ আটকে রাখুন। না হলে টয়লেট থেকেই এডিস মশার বংশবিস্তার হবে।
২২. বাসার আশেপাশে যদি কোনো ছোট-খাটো জলাশয় থাকে। নিচু পতিত জমি থাকে। যেখানে অল্প বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে। এমন জায়গার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। প্রয়োজনে নিয়মিত মশা নিরোধক স্প্রে ব্যবহার করতে হবে। যেন এখানে এডিস মশার বদ্ধভুমি তৈরি না হয়।
২৩. বাসা-বাড়ির পরিবেশের দিকে নজর দিন। কোনো অবস্থাতেই বাসার পরিবেশ স্যাঁতসেঁতে হতে দিবেননা। বাসার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণে অন্যান্য রোগ বিস্তারে করতে পারে। তাছাড়া এডিশ মশার জন্য উপর্যক্ত পরিবেশ। তাই বাসার স্যাঁতসেতে পরিবেশ দূর করুন।
২৪. বাসায় মশা মারার একটি ব্যাট রাখুন। দিনে-রাতে যখনই মশা চোখে পড়বে, তখনই ব্যাট দিয়ে মশা মারুন।
২৫. বাসায় কোনো রুমেই যেন অব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা না থাকে। শয়ন কক্ষ আবর্জনা মুক্ত ও নিরাপদ রাখুন। শয়ন কক্ষের জানালায় এবং ভেন্টিলেটরে নেট ব্যবহার করুন।
২৬. রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মশারীছাড়া ঘুমাবেননা।
২৭. ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করবেননা।
২৮. বাসার বাইরে গেলে ফুলহাত শার্ট-প্যান্ট, এবং সাথে জুতা মুজা ব্যবহার করুন।
২৯. অযথা পাড়ায় চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিবেননা।
৩০. বাসায় নিচে বসে বসে আড্ডা দিবেননা।
৩১. জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করান।
৩২. ডেঙ্গু জ্বর হলে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিন।
৩৩. সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে।
৩৪.ডেঙ্গু প্রতিরোধে সৃজনশীল উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৩৫. প্রতিটি নাগরিক সচেতন হবে।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ দেখা দিলে করণীয়:
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ দেখা দিলে মোটেই অবহেলা করা যাবেনা। জ্বরের শুরুতেই ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে। নিয়মিত ডাক্তার ফলোআপে থাকতে হবে। জ্বর বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
- ডেঙ্গু জ্বর হলে প্রচুর বিশ্রম নিতে হবে।
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- এছাড়া তরল খাবার খান।
- তরল খাবার হিসেবে ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস খেতে পারেন।
- জ্বর হলে প্যারাসিটামল খেতে হবে। প্রতিদিন চারটি থেকে পাঁচটি প্যারাসিটামল খেতে পারবেন। তবে জ্বর থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করুন।
- ডেঙ্গু জ্বর হলে অ্যাসপিরিন জাতীয় ব্যথার ওষুধ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ ব্যথার ওষুধ খেলে রক্ত ক্ষরণ হতে পারে।
উপসংহার:
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ডেঙ্গু সংক্রমণের এই পিক টাইমে আমাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু এখন কেবল ঢাকা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সারা বাংলাদেশে ছড়িয়েছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। তাই শহর থেকে গ্রামে প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন হলেই কেবল ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। আসুন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাই এক সঙ্গে কাজকরি। ডেঙ্গু মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন। প্রতিদিনের আপডেট তথ্যের জন্য।
আমাদের সাইটের অন্যান্য পোস্ট পড়তে চাইলে Shrabonbd.com ভিজিট করুন। এমন অনেক স্বাস্থ্য সর্ম্পকিত আর্টিকেল পড়তে পারবেন।